তপন বসু॥ মাদক ব্যবসা, সেবনকারী ও সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা। উপজেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পরেছে মাদকের ভয়াল থাবা। মরণ নেশায় জড়িয়ে পরছে যুব সমাজ থেকে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও, বাদ নেই সাবেক ও জনপ্রতিনিধিরাও। পুলিশের তালিকায় মাদকের গড ফাদার হিসেবে ব্যবসায় জড়িত রয়েছে পুলিশ প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তার ভাইয়ের নামও। ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন হয়ে পরেছেন অভিভাবকেরা। পুলিশ প্রশাসনের অভিযানে মাঝেমধ্যে কয়েকজন মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারী গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে সহজেই জামিনে বেরিয়ে সদর্পে তাদের পুরোনো মাদক ব্যাবসা ও সেবনে জড়িয়ে পরেছে। গত এক সপ্তাহে আগৈলঝাড়ায় মাদকসহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মাদকের ওই মামলায় পালিয়ে গিয়ে আসামী হয়েছে আরও পাঁচ জন। দ- দেয়া হয়েছে এক জনকে, পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে সাজাপ্রাপ্ত দুই পলাতক আসামী। আইজিপির’র নির্দেশে পুলিশের মাদক বিরোধী চলমান বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত আগৈলঝাড়ায় আটক হয়নি পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়িদের কোন গড ফাদার। উদ্ধার হয়নি মাদকের কোন বড় চালানও।
সংশ্লিষ্ঠ সূত্র মতে, ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর বরিশাল জেলা পুলিশ লাইনে রেঞ্জ ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলামের কাছে জেলার ১০ উপজেলার মাদক ব্যবসায়ি ও সেবন কারীরা আত্মসমর্পন করেছিল। সেখানে আগৈলঝাড়া থানা এলাকা থেকে মাত্র ১৪ জন আত্মসমর্পনের তালিকায় নাম দেখিয়েছিলেন তৎকালীন ওসি মনিরুল ইসলাম। এর আগে ওই বছর ১৩ থেকে ১৫ মার্চ আগৈলঝাড়া থানা চত্তরে পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী, সেবনকারী ও তালিকা বহির্ভূত মোট ৭০ জনের একটি লম্বা তালিকা আত্মসমর্পন দেকায় তৎকালীন ওসি মনিরুল ইসলাম। তাতে মাত্র দুই জন মাদকের গডফাদার আত্মসমর্পণ করা দেখানো হলেও আত্মসমর্পণকারী কেউই পুলিশের কাছে তাদের ব্যবসার কোন মাদকই পুলিশের কাছে জমা দিতে হয়নি। ফলে থানায় আত্মসমর্পনকরা ওই অনুষ্ঠানটিকে থানা পুলিশের ‘আই ওয়াশ’ বলেই তখন দেখেছিলেন সাধারণ জনগন। পুলিশ বিভাগ আত্মসমর্পণকারীদের অনেককেই বিভিন্নভাবে সহায়তার মাধ্যমে পুনর্বাসন করলেও পূর্বের আত্মসমর্পনকরা মাদক ব্যবসায়ি ও সেবনকারীরা পরে সেই পুলিশের হাতেই একাধিকবার মাদকসহ গ্রেফতার হয়ে মামলার আসামী হয়েছে। মাদকসহ থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া মামলা সূত্র মতে, গত ১৫মে গৌরনদী উপজেলার নন্দপট্টি গ্রামের শফি উদ্দিন ওরফে সফিজদ্দিন মৃধার ছেলে সেন্টু মৃধা (৪৫)কে রাজিহার ইউনিয়নের চেঙ্গুটিয়া গ্রামের চৌদ্দমেদা বিলে অভিযান চালিয়ে একটি টোং ঘর থেকে ৭২পিচ ইয়াবাসহ পুলিশ গ্রেফতার করলেও সেন্টুর অপর সহযোগী পালিযে যায়। পুলিশ জানিয়েছে, সেন্টু গৗরনদীর খাদেম হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী। এছাড়াও সেন্টুর বিরুদ্ধে আগৈলঝাড়া থানায় গণধর্ষণসহ দুইটি, গৌরনদী থানায় হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজী, বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইন, বিশেষ কক্ষমতা আইন ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইনে ১৪টি ও কালকিনী থানায় দুইটি মামলাসহ মোট ১৮টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় সেন্টু পলাতক ছিল। গৌরনদীর প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে ও পুলিশের প্রচ্ছন্ন মদদে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করত। আদালতের সাজা ঘোষণার পর আগৈলঝাড়ার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির পরোক্ষ আশ্রয়ে চৌদ্দমেদা বিলে অবস্থান নিয়ে সেন্টু আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রন ও পরিচালনা করে আসছিলো। গ্রেফতারকৃত সেন্টু পুলিশের কাছে ওই এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রনকরা একাধিক সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি এবং প্রভাবশালীদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। ইয়াবাসহ সেন্টু গ্রেফতারের ঘটনায় ওই দিনই পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। রতœপুর ইউনিয়নের বরিয়ালি গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান মাখন সন্যামত ও হুসনে আরা বেগম পেয়ারার ছেলে মনিরুল ইসলাম ওরফে মানিক স্যনামতকে (২২) ২১ মে ১শ ১০পিচ ইয়াবাসহ পুলিশ গ্রেফতার করলেও তার অপর দুই সহযোগী ব্যবসায়ি পালিয়ে যায়। গ্রেফতারকৃত মানিক থানা পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদকের পাইকারী বিক্রেতা। মানিক সিন্ডিকেট টেকনাফ থেকে বরিশাল শহর ও আগৈলঝাড়ার বিভিন্ন এলাকায় মাদকের পাইকারী ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করছে। মানিকসহ তিন জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। একই দিন বাকাল গ্রামে নুরুল হক ফকিরের ছেলে আমিনুল ইসলাম ফকির (২২) মাদক সেবনরত অবস্থায় তার পিতা মতাকে মারধরের খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে আমিনুলকে আটক করে। ওই দিন আমিনুলকে ভ্রাম্যমান আদালত ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদ-র রায় প্রদান করেন। আমিনুল এর আগেও একই ঘটনায় ভ্রাম্যামান আদালতে ১ বছরের কারাদন্ডের রায়ে দন্ডিত হয়েছিল। সম্প্রতি উপজেলার বাইপাস সড়কের ফুল্লশ্রী এলাকায় আগৈলঝাড়া থানা পুলিশের সহায়তায় গৌরনদী থানা পুলিশ একটি কফি হাউসে অভিযান চালিয়ে আগৈলঝাড়ার (গাইবান্ধায় কর্মরত) এক উচ্চ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার ছোট ভাইকে ৪শ পিচ ইয়াবাসহ আটক করে বেদম মারধর করে। আগৈলঝাড়া থানা পুলিশের এক এসআই নিজেকে ওই কর্মকর্তার আস্থাভাজন লোক হিসেবে জাহির করতে মাদকসহ আটকের ঘটনা সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোনে জানালে ওই পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা গৌরনদী থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে তার ভাইকে ছাড়িয়ে নেয়। যা টক অফ দা টাউনে পরিণত হয়।
২২ মে পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে ভদ্রপাড়া গ্রামের ইয়াসিন সরদারের ছেলে মাদক মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী মো. নাসির সরদার (২৮)কে গ্রেফতার করেন। নাসির জিআর ৬৯/১৩ মাদক মামলার ৬মাসের সশ্রম কারাদ- প্রাপ্ত আসামী ২৩ মে উপজেলার বড় বাশাইল শহীদ সুকান্ত আবদুল্লাহ কলেজের পাশের একটি মাছের ঘের থেকে অভিযান চালিয়ে বাশাইল গ্রামের কালীপদ দাসের ছেলে মাদক ব্যবসায়ি নিরূপম দাস (২২)কে ইয়া বিক্রির সময় ১৩পিচ ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে। এসময় পুলিশের টের পেয়ে নিরূপমের অপর তিন সহযোগী পালিয়ে যায়। পুলিশ জানিয়েছে নিরূপম ঢাকায় একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালযেল ছাত্র। সে ঢাকায়ও মাদকের ব্যবসা করে। এঘটনায় পুলিশ চার জনকে আসামী করে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইনে মামলা দায়ের করেছে। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দ্বায়িত্বে থাকা ওসি (তদন্ত) খোন্দকার আবুল খায়ের বলেন, মাদকের তালিকাভুক্ত গডফাদারদের গেফতারে সর্বত্মক চেষ্টা চলছে। খুচরা বিক্রেতা ও সেবনকারীদের আইনের আওতায় আনতে আলাদা নজরদারীতে রাখা হয়েছে। মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহ রয়েছে। খুচরা বা পাইকারী ব্যবসায়ি কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। আগৈলঝাড়া থানা পুলিশ মাদক বিরোধী অভিযানে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে বলেও জানান তিনি
Leave a Reply